মা বললেন, কোথায় ছিলি?
- দাদীমার ঘরে।
- এই ভর সন্ধ্যায় পড়ালেখা নেই? দাদীমার ঘরে কি হ্যাঁ?
আমি আমতা আমতা শুরু করলাম। মা মানে পেট ব্যাথা ছিলো, পানি পড়া, দাদীমার সূরা আবোল তাবোল কি বলেছিলাম মনে নেই তবে মা সেসব না শুনেই ধমক লাগালেন।
- এই সব বাহানা ছাড়। অনেক জানা আছে। আর একদিন যদি দেখি ভর সন্ধ্যায় পড়ালেখা ছেড়ে দাদীমার কাছে আল্লাদ হচ্ছে তো ......
মা রাগ করছিলো আর আমার পেট ফেটে হাসি আসছিলো। তবুও সুদক্ষ অভিনেত্রীর মত করুন মুখে মায়ের দিকে চেয়েছিলাম। মা সেই অভিনয়ে ভুললেন না। বললেন, হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। পড়ালেখার সময় হলেই তোমার দুনিয়ার তাল বাহানা শুরু হয়। গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন মা।
আর আমি এক দৌড়ে পড়ার টেবিলে এসে খাতার ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে খোকাভায়ের ছবি আঁকার চেষ্টায় রত হয়ে পড়লাম। ছবি আঁকতে দেখলেই মা রাগে পাগল হয়ে যেতেন। মা অবশ্য পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়ার যাই করি না কেনো সব কিছুতেই রাগে পাগল হতেন। একমাত্র তার ইচ্ছায় নাচ শেখা ছাড়া আর সব কিছুই তার চোখে ছিলো খারাপ কাজ। তাতে কি যায় আসে? কেউ কি কারো সুপ্ত প্রতিভা জোর করে আটকাতে পারে? তাও আবার আমাকে! সে যাইহোক আমি সেই সন্ধ্যা থেকে ঘন্টা তিনেক পড়ার অভিনয় করে একান্ত প্রচেষ্টায় খাতার ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিক ঠাক প্রায় খোকাভাইকেই এঁকে ফেললাম। তবে কিছুতেই তার চশমা পরা চোখ দুইটা আঁকতে পারছিলাম না। তাতে কি! অতি অল্পেই আমি খুশি হয়ে যাই। সেই ছবি এঁকেও আমি খুশি। খোকাভাইকে এই ছবি দেখিয়ে চমকে দেওয়া যাবে। সেই ফন্দি পেতে ঐ রাত দুপরেও আমি মিটিমিটি হাসছিলাম।
যখনই যত লুকিয়েই যাই করি না কেনো মা কই থেকে যেন এসে হাজির হতেন। কাজেই আমার ঐ দুরাভিসন্ধিপূর্ণ মিটিমিটি হাসি দেখেও কই থেকে মা যেন ভোজবাজীর মত উদয় হয়ে গেলেন আমার সামনে।
- কি সারাক্ষন এত হাসি কিসের শুনি?
আমি আবারও আমতা আমতা! না মানে মানে ! কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমিও তারপর রেগে গিয়ে বললাম,
-আমি কি তাইলে সারাক্ষন কাঁদবো নাকি?
মা আমার রাগ আর মুখে মুখে উত্তর শুনে রাগে পাগল হয়ে গেলেন।
- কি! বেয়াদপ মেয়ে! দিনে দিনে পাখনা গজাইছে না? মুখে মুখে কথা!
আর একটু হলেই সেদিন আমার খবরই ছিলো। মা যদি রাগে আমার খাতা কেড়ে নিয়ে দেখতেন তো হয়েছিলো আর কি। তবে ভাগ্যের অশেষ জোরে ঠিক সেই সময় ছোট চাচীমা এসে মাকে ডাকতে লাগলেন তার ঘরে তার বাবার দেশ থেকে আনা জাফরান আর কাজু বাদাম আর কাশ্মিরী সালোওয়ার কামিজ, শাল এ সব দেখে যাবার জন্য। উনি মায়ের চেঁচামেচি শুনে উর্দূতে বলতে লাগলেন, আরে ছোট বাচ্চাদের উপর এত রাগ করো কেনো? আসো তো দেখে যাও হেন তেন কি কি যেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তাড়াতাড়ি খাতার পাতাখানা সযতনে ছিড়ে নিয়ে টেবিলক্লথের নীচে রেখে দিলাম নিরাপদে। যেন মা খুঁজেও না পায় আর ভাঁজও না পড়ে।
মা আমাকে বড় বেশি চোখে চোখে রাখতেন। মায়ের কান্ড কারখানা দেখে মনে হত সুযোগ পেলেই আমি এমনই অঘটন ঘটাবো যেটাতে লজ্জায় মায়ের মাথা কাটা যাবে, মান সন্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। মা ছাড়াও দাদী চাচী ফুপীদের এক কড়া শাসন ছিলো আমাদের সব ভাইবোনদের উপরে সব কাজেই। উঠতে বসতে নানা আদেশ উপদেশ আর নির্দেশের জ্বালায় প্রাণ হত ওষ্ঠাগত। তবুও আমি তারই মাঝে ছিলাম থোড়াই কেয়ার। ঐ যে কথায় আছে না বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। আমি সেই গেরো ফস্কেই বের হয়ে যাবার নানান ছুঁতো নাতা খুঁজে বেড়াতাম। আর সত্যি বলছি কেউ যদি বজ্র আঁটুনি খুলে ফেলার এইম নেয় জীবনে তো বজ্রকঠিন বা লৌহকঠিন বাঁধনেও তা বাঁধা সম্ভব হয় না। এ কথাটাই বুঝতে চাইতো না আমাদের বাড়ির লোকজন সব কাজেই তাদের না আর না ছিলো। এখানে যাওয়া যাবে না, ওটা করা যাবে না সেটা ধরা যাবে না নানান রকম বাহানা আর কি।
তবে হ্যাঁ ঐ চাচা ফুপুদের ১৩/১৪ জন ছেলেমেয়েদের সুবাদে বাড়ি ভরেই থাকতো সারাদিন নানারকম চাঞ্চল্যে। শুধু আমার খোকাভাই থাকতো একাকী নীরজনে। যদিও আমার কাজের নামে অকাজের জুড়ি ছিলো না তবুও খোকাভাই ও ছাদের ঘরে বাস শুরু করবার পর থেকেই আমার কারণে অকারনেই ছাঁদে ওঠা বেড়ে গিয়েছিলো। যেমন দাদীমার আচার রোদে দেওয়া বা চাচীমার আমসত্ব ছাঁদে ঠিকঠাক ঢেকে দেওয়া এসব আমি আগ বাড়িয়ে করতে শুরু করলাম। এমনকি বিকাল হতেই ছাদে রোদে শুকুতে দেওয়া কাপড় তুলতে আমার তর সইতো না। এসবের আসল উদ্দেশ্যই ছিলো আমার খোকা ভাই। প্রতিটা বারই আমি এই সব কাজের ছুতোনাতায় ছাদে উঠে উঁকি দিতাম তার ঘরে।
পরদিন একইভাবে খুব ভোরে উঠে স্কুল যাবার আগেই সকলের অগোচরে উঠে গেলাম ছাঁদে। ভেবেছিলাম খোকাভাই ঘুমিয়ে থাকার সুযোগে চুপি চুপি তার টেবিলের উপরে রেখে আসবো আমার হাতে আঁকা অমর অমূল্য চিত্রাঙ্কনখানা। ওমা ছাঁদে উঠে দেখি খোকাভাই ঐ ভোর সকালে উঠে কবুতরের ছোট ছোট দুইটা ছানাকে হাতে করে কি যেন খাওয়াচ্ছে। আমাকে দেখেই এক আঙ্গুল ঠোঁটে চেপে চুপ থাকতে বললেন যেন ঐ কবুতরের বাচ্চারা ভয় না পেয়ে যায়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সেই দৃশ্য। পরে অবশ্য সেই কবুতর হাতে খোকাভায়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করতে করতে দুইশোবারে আমি বোধ হয় সফল হয়েছিলাম। হা হা
যাইহোক, খোকাভায়ের জন্য অপেক্ষায় আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছিলো কখন মা উঠে আসেন উপরে। কিন্তু খোকাভায়ের তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। এক মনে তাদের শেষ দানাটা পর্যন্ত খুঁটে খাবার অপেক্ষায় বসে ছিলো সে। বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম আমি। তবুও আশা নিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। খোকাভাই শেষ মেষ হাত ঝেড়ে বললো,
- এত সকালে ছাদে এসছিস কেনো? স্কুল নেই?
- আছে। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এসেছি।
- বিশেষ কারণ!
আবারও ভ্রু কুঁচকালো খোকা ভাই। জিজ্ঞাসা তার কুঞ্চিত চোখে। আমি পেছনে লুকানো ছবিটা বের করে মেলে ধরলাম পানির নীচু ট্যাংকটার উপরে। তারপর এক হাতে ছবিটার কাটা কুটি করে আঁকতে না পারা চোখের জায়গাটা ঢেকে বললাম।
- বলোতো এটা কার ছবি?
- কার আবার?
- কার?
আনন্দে আমার দুচোখে কৌতুক ঝরছিলো। খোকাভাইকে দেওয়া আমার নিজের হাতে আঁকা উপহার। কিন্তু এক নিমিষেই সেই আনন্দ শেষ হয়ে গেলো খোকাভাই এর উত্তরে।
- কার?
- হুম কার বলোতো?
- কার আবার হরিদাস কাকার।
হরিদাস কাকা একজন ভালোমানুষ পাগল ছিলেন যিনি রোজ রাতে কই থেকে এসে হাজির হতেন আমাদের বাড়ীর মেইন গেটের সামনে লাগোয়া পাকুড় গাছটার তলায়। সেটাই তার আবাস ছিলো। বাড়িতে রান্না হওয়া রোজকার খানাপিনা ছাড়াও বিশেষ কিছু ভালো মন্দ রান্না হলেই তার জন্যও ভাগ থাকতো বাড়ির মহিলাদের। সেই কাকাকে আমরা বড় ভালোবাসতাম। ঈদ পার্বনে তাকে কাপড়ও দিতাম আমরা। কিন্তু হরিদাস কাকা তো শুধু কাকাই নয়। উনি ছিলেন হরিদাস পাগলা। সেই নতুন কাপড় দুদিনেই ছিড়ে খুড়ে শেষ করতেন।সেই এক মুখ দাঁড়ি গোফের হরিদাস কাকাকে এঁকেছি বললো খোকাভাই।
আমি মুখ হাড়ি করে বললাম, যাও তোমার সাথে আমি আর কোনোদিন কথা বলবো না। এই কথা বলেই সেই অমূল্য সাড়ে তিন ঘন্টায় অঙ্কিত চিত্রখানি ছুড়ে ফেলে উল্টো দিকে ছুট লাগালাম আমি। পেছন থেকে শুনতে পেলাম হো হো করে হাসছে খোকাভাই। তবুও আমার রাগ আসলে দুঃখ কমলো না। মানে আসলে অপমান। আমার এত কষ্টের মূল্য এমন বিফলে গেলো।
রাগে আমি তারপর ৪ দিন ছাদেই আর আসলাম না।
সেদিন কি কারণে যেন স্কুল আধাবেলা হয়েই ছুটি হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ বাড়ি ফিরে দেখি মা ঘুমুচ্ছেন। মা ঘুমানোর সময়টুকু সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার দারুন সুখের সময়। তখন সারাদিনের জমানো দুরাভিসন্ধিগুলি করার মোক্ষম সুযোগ হত। কাজেই সব রাগ দুঃখ ভুলে আমি চুপি চুপি পা বাড়ালাম ছাদের ঘরে। বাসার কাজে লোকজন থেকে শুরু করে সবাই তখন দুপুরের আলস্যে নীরব হয়ে ছিলো। সেই সুযোগে আমি পা টিপে টিপে উঠে উঁকি দিলাম খোকাভায়ের ঘরে। দেখলাম খোকাভাই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। শোয়ার ভঙ্গিটা একটু অসাড় অচেতন।
কাছে এগিয়ে যেতেই মনে হলো মুখটা কেমন যেন লালচে হয়ে আছে। আমার খুব ভয় হলো। কি হয়েছে খোকাভায়ের? আমি ডাকলাম, এ্যাই খোকাভাই। কোনো উত্তর নেই। আবারও ডাকলাম। কাছে গিয়ে কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলাম আমি। প্রচন্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ এই বাড়ির একটা লোকও জানেনা সে খবর। কারো কোনো মাথা ব্যাথাই নেই এই ছাঁদের ঘরের একাকী নীরজনে একটা ছেলে এই মধ্য দুপুরে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমার এত কষ্ট হচ্ছিলো। আমি ডাকলাম খোকাভাই। এত জ্বর তোমার! কেউ জানে না! খোকাভাই চোখ মেললো। লাল টকটকে চোখ। অস্ফুটে বললো,
- মা। মাকে একটু ডেকে দিতে পারবি নীরু?
আমি এক ছুটে নীচে গিয়ে চাচীমাকে ডাকলাম। চাচীমা তখন বসে হাতে সেমাই কাটছিলেন। আমার কথা শুনে চমকে উঠলেন। তার চোখ পানিতে ছলছল করছিলো। মুখে আঁচল গুজে আমার সাথে তড়িঘড়ি উঠে এলেন ছাঁদের ঘরে। তারপর আমি আর চাচীমা দুজনে মিলে এক বালতি পানি নিয়ে মাথা ধুইয়ে দিতে শুরু করলাম খোকাভাইকে। চাচীমা নিশব্দে কাঁদছিলেন। একটাও কথা বলছিলেন না। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিলো। খোকাভায়ের কষ্টের চাইতেও চাচীমার কষ্ট দেখে। নিশব্দে কাঁদছিলেন চাচীমা। যেন তার কান্নার শব্দ শুনলে এ বাড়ির লোকেরা তার আশ্রয়টুকু কেড়ে নেবে।
এ বাড়িতে এত আয়োজন এত হাসি খেলা। তবুও এ বাড়ির দুটি পরাশ্রয়ী নর ও নারীর এত কষ্ট কেনো! ঐ বয়সে পুরোটা না বুঝলেও অনেকটাই বুঝে গেলাম আমি। তাই সবাই যাদেরকে অবহেলা করতো আমি শুধু তাদেরকেই ভালোবেসেছিলাম। মনে হয় ঐ বাড়ির একমাত্র আমিই ছিলাম ওদের ভালোবাসাদাত্রী আর কেউই নয়। কিছু পরে আমি দাদীর কাছে গিয়ে ওষুধের বাক্স হতে জ্বরের ঔষধ নিতে গেলাম। দাদী চোখ বুজে ছিলেন। আমাকে ঔষধ নিতে দেখে জানতে চাইলেন। কার কি হয়েছে? আমি বললাম খোকাভায়ের অনেক জ্বর। চাচীমা ঔষধ চাচ্ছেন। দাদী কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। আমি ফিরে যাবার সময় বললেন,
- দাঁড়া
তারপর আমার সাথে উঠে এলেন ছাঁদের ঘরে। চাচীমা তখনও কাঁদছিলেন। দাদীমাকে দেখে মাথায় আঁচল তুলে দিলেন। কিছু বললেন না। দাদীমা খোকাভায়ের গায়ে হাত রেখে বললেন,
- নীরু যা ছোট চাচাকে বলে আয় পবন ডাক্তারকে ডেকে আনতে। বলবি আমি বলেছি। জরুরী দরকার।
এরপর দাদীমার কৃপায় খোকাভায়ের জন্য একটু হলেও ভালো কিছু ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা হলো। তবুও দাদুর অজান্তে এবং বাড়ির চাচা চাচীদের বিরক্তির মুখে বেশি কিছু করা গেলো না। জ্বরের পরের কয়েকটা দিন খোকাভাই খুব দূর্বল ছিলো। পড়ে পড়ে ঘুমাতো শুধু। এদিকে চাচীমা কিছুদিন ব্যাস্ত থাকায় বাড়ির লোকজনের বিরক্তি শুরু হয়েছিলো। শুধু শুধু বিনা খাঁটুনীতে তো আর দু'দুটো পেটের খাওয়া জুটবে না তাই চাচীমাকে রিতীমত খোঁটার হাত থেকে বাঁচতেও কাজ করতে হত। শুধু কাজই না সেটা ছিলো উদয়স্ত পরিশ্রম।
তাই চাচীমার ব্যস্ততার অবসরে আমিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম খোকাভায়ের সেবার ভার। সেটাও অবশ্য সকলের চোখ এড়িয়ে বাড়ির অন্যান্যদের অগোচরে। চাচীমা দেখেও দেখতেন না বুঝেও বুঝতেন না শুধু তার নীরব চোখে ছিলো কৃতজ্ঞতা। একদিন ছুটির দিনের সকালে। তখন প্রায় দুপুর গড়াচ্ছে। চাচীমা আমাকে ইশারায় ডেকে এক বাটি কাটা আমড়া হাতে দিয়ে বললেন,
- খোকার ঘরে এটা দৌড়ে দিয়ে আয় তো নীরু। জ্বরের পরে অরুচি হয়েছে। কিছুই খেতে পারে না খোকা। আমড়া খেলে রুচি ফিরবে।
আমি সানন্দে সেই বাটিখানা নিয়ে দৌড়ে উঠলাম খোকাভায়ের ঘরে।
একটা কথা বলি, সেসব দিনে আমি কোনোদিন এক সিড়ি দুই সিড়ি করে উঠতাম না। একদম একবারে ৩/৪ সিড়ি টপকে দুদ্দাড় দৌড়ে ছাড়া পিলপিল পিপিলিকার মত চলন বলন আমার মোটেও ভালো লাগতো না। মা বলতেন ওমন করে হাঁটা চলা করলে লোকে গেছো মেয়ে বলবে। জীবনেও বিয়ে হবে না। হলেও পরেরদিন ফিরায় দিয়ে যাবে। বলবে গেছো মেয়ের দরকার নেই। আমি হাসতে হাসতে মরে যেতাম সে সব কথা শুনে। তবুও ওমন দুদ্দাড় দৌড়ানো ছাড়া আমি চলতেই পারতাম না। মানে চাইতামও না। আর গেছো বলুক আর মেছো বলুক গাছে ওঠা ব্যাপারটাও আমার দারুন আনন্দের কাজ ছিলো। একই সাথে মাছ ধরাটাও। বাগানের কোন গাছটায় কেমনে উঠতে সোজা আর কোন কোন গাছে ওঠা প্রায় অসম্ভব সবই ছিলো আমার নখদর্পনে। তবুও সেসব অসম্ভবকে সম্ভব করতে চলতো আমার নিত্যদিনের চর্চা আর গবেষনা। আর গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দোল খাওয়া সে তো ছিলো আমার মহানন্দের আনন্দময় এক কাজ!
যাইহোক এক বাটি আমড়া হাতে দুদ্দাড় নিশব্দে সিড়ি ভেঙ্গে উঠে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম খোকাভায়ের দরজায়। খোকাভাই ঘুমিয়ে ছিলো। নিশব্দে আমড়ার বাটিটা টেবিলে রেখে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম খোকাভায়ের মাথার কাছে। উদ্দেশ্য ছিলো চমকে দেওয়া। কিন্তু খোকা ভাই ঘুমুচ্ছিলো। শিশুর মত নিস্পাপ মুখখানা ঘুমে কাতর। ঘুমালে সব মানুষকেই মনে হয় নিস্পাপ লাগে। আমি তাকিয়ে রইলাম তার সেই মুখখানার দিকে অপলক। ডেকে উঠাতে মন চাইলো না তাকে। খুব খুব মায়া হচ্ছিলো আমার এই দুখী ছেলেটার জন্য। অনেকক্ষন তাকিয়ে তারপর তার মাথার কাছে মেঝের উপর হাঁটু গেড়ে বসলাম আমি।
খুব সন্তর্পণে ঠোঁট ছোয়ালাম খোকাভায়ের চোখের পাতায়। খোকাভাই অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। চোখের পাতা একটু কাঁপলো কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো না। আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ির শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।
চলবে...
ছবি- আমার আঁকা
মডেল- জাহিদ অনিক ভাইয়া